বাংলাদেশের কৃষি পরিবেশিক অঞ্চলের উর্বরতার অবস্থা

বাংলাদেশ একটি কৃষিনির্ভর দেশ, যেখানে বিভিন্ন ধরনের কৃষি পরিবেশিক অঞ্চল রয়েছে। দেশের মাটি প্রধানত অলুভিয়াল, ল্যাটেরাইট, ও পাহাড়ি অঞ্চলের মাটিতে বিভক্ত, যা উর্বরতার দিক থেকে ভিন্নতা প্রদর্শন করে।

বাংলাদেশের প্রধান কৃষি পরিবেশিক অঞ্চল ও তাদের উর্বরতা

  1. বড় নদীবাহিত পলল অঞ্চল (বঙ্গবঙ্গীয় ব-দ্বীপ অঞ্চল)
    • এই অঞ্চলের মাটি প্রধানত বেলে, দোআঁশ ও এটেল ধরনের এবং এটি অত্যন্ত উর্বর।
    • গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীর পলিমাটি প্রতি বছর জমা হয়, ফলে ফসলের জন্য এটি অত্যন্ত উপযোগী।
    • ধান, গম, পাট, শাকসবজি, ডাল ইত্যাদি এখানে ভালো জন্মে।
  2. মধ্যাঞ্চলের প্লাবনভূমি ও নিচু অঞ্চল
    • এসব অঞ্চলে প্রতি বছর বন্যা হয়, যা মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে।
    • জৈব পদার্থের পরিমাণ বেশি থাকায় ধান উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত উপযোগী।
    • তবে বেশি জলাবদ্ধতার কারণে কিছু জায়গায় লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
  3. বরেন্দ্র অঞ্চল (উত্তর-পশ্চিম বাংলাদেশ)
    • রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও বগুড়ার কিছু অংশ এই অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত।
    • মাটি বেশিরভাগই লালচে ও কঠিন প্রকৃতির, যা তুলনামূলক কম উর্বর।
    • সেচের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন সম্ভব হলেও জৈব পদার্থের পরিমাণ কম থাকায় উর্বরতা কিছুটা হ্রাস পাচ্ছে।
  4. চর অঞ্চল (নদীবাহিত নতুন পলিমাটি অঞ্চল)
    • এই অঞ্চলে প্রতি বছর নতুন করে পলিমাটি জমা হয়, ফলে এটি অত্যন্ত উর্বর।
    • ধান, তিল, পাট, ডাল ইত্যাদি ভালো হয়, তবে বন্যার ঝুঁকি বেশি।
  5. সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল
    • সিলেটের মাটি বেশিরভাগ দোআঁশ ও লোমযুক্ত, যা চা, কমলা, পান, আনারস ও কফির জন্য উপযোগী।
    • পার্বত্য অঞ্চলের মাটি সাধারণত লালচে ও অম্লীয় প্রকৃতির হওয়ায় কিছু জায়গায় উর্বরতা কম। তবে শিফটিং কালচারের কারণে মাটির গুণগত মান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
  6. দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় লবণাক্ত অঞ্চল
    • খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও পটুয়াখালীর অংশবিশেষ এই অঞ্চলে পড়ে।
    • লবণাক্ততার কারণে সাধারণ ফসল উৎপাদন কঠিন, তবে চিংড়ি চাষ ও লবণসহনশীল ধান উৎপাদন সম্ভব।
  7. পাহাড়ি ও টেরেস অঞ্চল
    • পাহাড়ি অঞ্চলের মাটি সাধারণত লালচে ও কম উর্বর, তবে সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ফল ও চা উৎপাদন করা যায়।
    • কক্সবাজার ও বান্দরবানের কিছু অংশে তামাক, আদা ও হলুদ চাষ হয়।

বাংলাদেশের মাটির উর্বরতার হ্রাস ও চ্যালেঞ্জসমূহ

  • অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে মাটির জৈব উপাদান হ্রাস পাচ্ছে।
  • সেচ নির্ভর চাষাবাদে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর কমে যাচ্ছে, যা ভবিষ্যতে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
  • বন উজাড়, ভূমিক্ষয় এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মাটির গুণগত মান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
  • উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততার পরিমাণ বাড়ছে, যা কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

উর্বরতা রক্ষায় করণীয়

  • জৈব সার ও কম্পোস্ট ব্যবহার বাড়ানো।
  • ফসলের ঘূর্ণন পদ্ধতি (Crop Rotation) অনুসরণ করা।
  • সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও পানি সংরক্ষণ।
  • লবণসহনশীল ও খরাসহিষ্ণু ফসলের জাত উদ্ভাবন ও চাষাবাদ করা।

উপসংহার

বাংলাদেশের কৃষি পরিবেশিক অঞ্চলগুলোর উর্বরতা সাধারণত ভালো হলেও কিছু অঞ্চলে মাটির উর্বরতা হ্রাস পাচ্ছে। টেকসই কৃষি ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করা হলে ভবিষ্যতে দেশের খাদ্য উৎপাদন ক্ষমতা আরও বাড়ানো সম্ভব হবে।