দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-১৯৪৫) প্রধান প্রভাব

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে বিধ্বংসী যুদ্ধ ছিল, যা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছিল। যুদ্ধটি প্রায় ৬ কোটি মানুষের মৃত্যু এবং অগণিত ধ্বংসযজ্ঞের কারণ হয়েছিল।


১. রাজনৈতিক প্রভাব

(ক) দুই পরাশক্তির উত্থান: যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন (USSR)

  • ইউরোপের দেশগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে, ফলে যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বের প্রধান দুই পরাশক্তি হয়ে ওঠে।
  • এই দুই দেশের মধ্যে ঠান্ডা যুদ্ধ (Cold War) শুরু হয়, যা বিশ্ব রাজনীতিকে দুই শিবিরে বিভক্ত করে।

(খ) জাতিসংঘ (United Nations) গঠন (১৯৪৫)

  • যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ ঠেকাতে ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘ গঠিত হয়। এটি আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য কাজ করে।

(গ) ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের পতন

  • দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে ব্রিটেন, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, পর্তুগাল ইত্যাদি দেশগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে।
  • এর ফলে ভারত (১৯৪৭), ইন্দোনেশিয়া (১৯৪৫), আলজেরিয়া (১৯৬২) সহ বহু দেশ স্বাধীনতা লাভ করে।

২. অর্থনৈতিক প্রভাব

(ক) ইউরোপ ও এশিয়ার অর্থনীতি ধ্বংস

  • যুদ্ধের কারণে ইউরোপ ও এশিয়ার অনেক দেশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।
  • জার্মানি, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জাপান – এসব দেশের অর্থনীতি মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ে।

(খ) মার্শাল প্ল্যান (Marshall Plan) ও অর্থনৈতিক পুনর্গঠন

  • যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের পুনর্গঠনের জন্য ‘মার্শাল প্ল্যান’ চালু করে (১৯৪৮), যার ফলে ইউরোপ দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে।

(গ) জাপানের অর্থনৈতিক পুনর্জাগরণ

  • পরাজিত জাপান যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় দ্রুত শিল্প ও প্রযুক্তিতে উন্নতি করতে থাকে এবং পরবর্তীতে বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি হয়ে ওঠে।

৩. সামরিক ও প্রযুক্তিগত প্রভাব

(ক) পরমাণু অস্ত্রের আবিষ্কার

  • ১৯৪৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা নিক্ষেপ করে, যা যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
  • পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু করে।

(খ) সামরিক প্রযুক্তির উন্নয়ন

  • জেট বিমান, সাবমেরিন, রাডার, ক্ষেপণাস্ত্র ও কম্পিউটার প্রযুক্তির অগ্রগতি ঘটে।
  • পরবর্তী সময়ে স্পেস রেস (মহাকাশ প্রতিযোগিতা) শুরু হয়, যার ফলে মানুষ চাঁদে পৌঁছায় (১৯৬৯)।

৪. সামাজিক ও মানবিক প্রভাব

(ক) গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন

  • নাজি জার্মানির ‘হলোকাস্ট’ (Holocaust) – প্রায় ৬০ লাখ ইহুদি হত্যা করা হয়।
  • যুদ্ধের পর মানবাধিকার সংস্থা ও আন্তর্জাতিক আদালত প্রতিষ্ঠা করা হয়

(খ) শরণার্থী সংকট

  • ইউরোপ ও এশিয়ায় কোটির বেশি মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে
  • যুদ্ধের ফলে নতুন দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ সমস্যার সৃষ্টি হয়।

(গ) নারী শ্রমশক্তির ভূমিকা বৃদ্ধি

  • যুদ্ধকালীন সময়ে পুরুষরা যুদ্ধে চলে যাওয়ায় নারীরা কারখানা, চিকিৎসা ও প্রশাসনিক কাজে যুক্ত হয়
  • ফলে নারীর ক্ষমতায়ন ও অধিকার আন্দোলনের নতুন ধারা শুরু হয়

৫. ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তন

(ক) পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপ বিভক্ত হওয়া

  • জার্মানি দুটি ভাগে বিভক্ত হয়:
    • পশ্চিম জার্মানি (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত)
    • পূর্ব জার্মানি (সোভিয়েত-সমর্থিত)

(খ) ঠান্ডা যুদ্ধ (Cold War) শুরু

  • যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে রাজনৈতিক ও সামরিক প্রতিযোগিতা শুরু হয়, যা ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের আগে পর্যন্ত স্থায়ী ছিল।

(গ) মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা (১৯৪৮)

  • যুদ্ধের পর ফিলিস্তিনের ভূমিতে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়, যা আরব-ইসরায়েল সংঘাতের সূত্রপাত করে।

উপসংহার

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে বিশ্বব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। পরাশক্তির নতুন ভারসাম্য, অর্থনৈতিক পুনর্গঠন, সামরিক প্রযুক্তির উন্নতি, মানবাধিকার ও স্বাধীনতার আন্দোলন – সবকিছুই এই যুদ্ধের প্রভাব হিসেবে গড়ে ওঠে।

আপনার যদি নির্দিষ্ট কোনো দিক সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে চান, জানাতে পারেন!