বাংলাদেশে ধর্ষণের মতো অপরাধের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পেছনে একাধিক সামাজিক, আইনি, নৈতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক কারণ রয়েছে। এটি একটি জটিল সমস্যা, যা কেবল আইন দিয়ে নয়, বরং সমগ্র সমাজব্যবস্থার সচেতনতা, শিক্ষাব্যবস্থা এবং মানসিকতার পরিবর্তনের মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব।
ধর্ষণের বৃদ্ধি পাওয়ার কারণসমূহ:
১. আইনের দুর্বল প্রয়োগ ও বিচারহীনতা
- অনেক ক্ষেত্রেই ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে মামলা হলেও অপরাধীরা প্রভাবশালী হলে পার পেয়ে যায়।
- দীর্ঘ বিচারপ্রক্রিয়া ও আইনের ফাঁকফোকরের কারণে ভুক্তভোগী ন্যায়বিচার পায় না।
- অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষক জামিন পেয়ে আবার অপরাধে লিপ্ত হয়।
২. সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি ও ভুক্তভোগীর প্রতি দোষারোপ
- ধর্ষণের শিকার নারীদের অনেক সময় সমাজই দায়ী করে, যা অপরাধীদের মনোবল আরও বাড়িয়ে তোলে।
- ভুক্তভোগী বিচার চাইতে গেলে সামাজিকভাবে লাঞ্ছিত হয়, ফলে অনেকে মুখ খোলে না।
- ধর্ষণের শিকার নারীকে ‘অসতী’ বা ‘সমস্যার মূল কারণ’ হিসেবে দেখা হয়, যা সমস্যাকে আরও গভীর করে।
3. অশ্লীল কনটেন্ট ও নৈতিক অবক্ষয়
- ইন্টারনেটে সহজলভ্য পর্নোগ্রাফি, বিকৃত যৌন কনটেন্ট ও অবৈধ ওয়েবসাইটে অশ্লীলতার প্রসার অনেক যুবকের মধ্যে বিকৃত চিন্তাভাবনার জন্ম দেয়।
- পর্নোগ্রাফির আসক্তি অনেক সময় বাস্তব জীবনে নারীকে ‘উপভোগের বস্তু’ হিসেবে দেখার প্রবণতা তৈরি করে।
- সামাজিক ও পারিবারিক শিক্ষার অভাবের কারণে অনেক তরুণ নারীকে সম্মান দিতে শেখে না।
৪. নারীর প্রতি অসম্মান ও পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব
- সমাজের একটি অংশ এখনো নারীকে ‘ভোগ্য বস্তু’ মনে করে, যা তাদের অধিকার ও নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলে।
- পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে অনেক পরিবারে ছেলেদের শেখানো হয় যে নারীর শরীরের ওপর তাদের অধিকার আছে।
৫. মাদক ও নেশাদ্রব্যের প্রসার
- ধর্ষণের সাথে জড়িত অপরাধীদের অনেকেই মাদকাসক্ত বা নেশাগ্রস্ত থাকে, যা তাদের নৈতিকতাকে নষ্ট করে দেয়।
- ফেনসিডিল, ইয়াবা, মদ ইত্যাদির সহজলভ্যতা অনেক অপরাধের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
৬. নারীর নিরাপত্তার অভাব
- রাতে একা বের হলে বা নির্জন জায়গায় থাকলে নারীদের জন্য যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই।
- পর্যাপ্ত সিসিটিভি ক্যামেরা, টহল পুলিশ বা নিরাপত্তা বাহিনী না থাকায় অপরাধীরা সাহস পায়।
৭. ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার অভাব
- নৈতিক শিক্ষার অভাবে অনেকে শৈশব থেকেই নারীকে সম্মান করতে শেখে না।
- ধর্ষণকে অনেক সময় সাধারণ অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়, যা তরুণদের মধ্যে নৈতিক অবক্ষয় ঘটায়।
৮. পর্নো ও যৌন শিক্ষার ভুল বোঝাবুঝি
- অনেকেই সঠিক যৌন শিক্ষা না পাওয়ায় বিকৃত মানসিকতা নিয়ে বেড়ে ওঠে।
- স্কুল-কলেজে যৌন শিক্ষা না থাকায় অনেক কিশোর-তরুণ পর্নো দেখে যৌনতা সম্পর্কে ভুল ধারণা তৈরি করে।
সমাধান কী?
✅ আইনের কঠোর প্রয়োগ: দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা।
✅ নারীর প্রতি সম্মানবোধ শেখানো: পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নারীর সম্মান ও অধিকার সম্পর্কে সঠিক শিক্ষা দেওয়া।
✅ পরিবারের ভূমিকা: ছেলে শিশুদের নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শেখানো এবং নৈতিক শিক্ষা দেওয়া।
✅ পর্নোগ্রাফি ও মাদক নিয়ন্ত্রণ: ইন্টারনেটে অশ্লীল কনটেন্ট বন্ধ করা এবং মাদকের প্রবাহ কমানো।
✅ নারীর নিরাপত্তা জোরদার করা: পাবলিক প্লেসে সিসিটিভি বসানো, রাতের বেলায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
✅ সঠিক যৌন শিক্ষা চালু করা: স্কুল-কলেজে যৌনতা নিয়ে ভুল ধারণা ভাঙতে সঠিক যৌন শিক্ষা দেওয়া।
শেষ কথা
ধর্ষণ একটি ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি, যা কঠোর আইন, পারিবারিক শিক্ষা, নৈতিকতা ও সামাজিক সচেতনতার মাধ্যমে কমানো সম্ভব। নারীকে মানুষ হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোই এর প্রধান সমাধান।
